ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব সাধারণত স্যার আইজ্যাক নিউটন এবং গটফ্রিড উইলহেল্ম লেইবনিজ এই দুই মহান বিজ্ঞানীর উপর বর্তায়। তবে এটি এককভাবে তাদের আবিষ্কার নয়, বরং বহু শতকের পুরনো গণিতবিদদের কাজের ধারাবাহিকতা এবং অগ্রগতির ফসল। ক্যালকুলাস মূলত দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত: ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস (Differential Calculus) এবং ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস (Integral Calculus)।
ক্যালকুলাস আবিষ্কারের ইতিহাস
ক্যালকুলাস এমন এক গণিতশাস্ত্র যা পরিবর্তন (ডেরিভেটিভ) ও সঞ্চিতির (ইন্টেগ্রাল) সাধারণ ভাষা। এর জন্ম একদিনে হয়নি—প্রাচীন জ্যামিতি থেকে ১৭শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব, আর ১৮–১৯শ শতকে কঠোর ভিত্তি নির্মাণ—সব মিলিয়ে দীর্ঘ এক বিবর্তনের ফল।
প্রাক-ইতিহাস: ক্যালকুলাসের ধারণার বীজ
- ইউডক্সাস ও আর্কিমিডিস (খ্রি.পূ. ৪র্থ–৩য় শতাব্দী, গ্রিস): “মেথড অব এক্সহস্টশন”-এ ধারাবাহিকভাবে বহুভুজ/ঘন আকৃতি বাড়িয়ে ক্ষেত্রফল-আয়তন অর্জন—এটা আসলে সীমার (limit) ধারণার পূর্বসূরি। আর্কিমিডিস বক্ররেখা তলে ক্ষেত্রফল, গোলকের আয়তন ইত্যাদি বের করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
- চীন ও মধ্যপ্রাচ্য: লিউ হুই, জু শিজিয়ে প্রমুখ π ও ক্ষেত্রফল নির্ণয়ে পুনরাবৃত্ত পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ইসলামি স্বর্ণযুগে ইবনে আল-হাইসমের “সমতল ঘাতের যোগের সূত্র” (sums of powers) ও অপটিক্সে চূড়ান্ত/ন্যূনতমের সমস্যা পরবর্তী ক্যালকুলাসের ধাঁচ গড়ে দেয়।
- ভারত (কেরল স্কুল, ১৪–১৬শ শতাব্দী): মাধব ও উত্তরসূরিরা সাইন, কোসাইন, ট্যানজেন্টের অনন্ত ধারা (infinite series) ও π-র জন্য মাধব-লেইবনিজ সূত্রের পূর্বসূরি । ধারার অভিসৃতি-অনভিসৃতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ ছিল ক্যালকুলাসের আরেকটি ভিত্তি।
রেনেসাঁ থেকে ১৭শ শতাব্দী: “অবিভাজ্য”, ট্যানজেন্ট ও বিশ্লেষণ
- ক্যাভালিয়েরি (১৬০০ দশক): “মেথড অব ইন্ডিভিজিবলস”—ক্ষেত্রফল/আয়তনকে অসংখ্য পাতলা রেখা/পাতের যোগফল হিসেবে ভাবা; আধুনিক ইন্টেগ্রেশনের ভাবনা।
- কেপলার, টরিচেল্লি, রবার্ভাল: বক্ররেখার দৈর্ঘ্য, ঘাতের যোগ, ঘূর্ণনের ঘন আয়তন—সব জায়গায় যোগফল-ধাঁচের কৌশল ছিলো ইন্টেগ্রেশনের-ই কৌশল ।
- ডেকার্ত ও ফের্মা: বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি (কো-অর্ডিনেট), ট্যানজেন্ট ও ম্যাক্সিমা–মিনিমা বের করার বীজগাণিতিক কৌশল—ডেরিভেটিভ ধারণার সরাসরি পূর্বসূরি।
- ওয়ালিস ও ব্যারো: অসীম গুণোত্তর/সমান্তর ধারায় সমীকরণ, আর ব্যারোর “অ্যান্টিডেরিভেটিভ”–এর মতো চিন্তা—ডিফারেনসিয়েশন–ইন্টেগ্রেশনের আন্তঃসম্পর্ক এর কাছে নিয়ে যায়।

নিউটন ও লেইবনিজ: সমান্তরাল দ্বৈত আবিষ্কার
মূলত, ১৭শ শতকের শেষের দিকে নিউটন এবং লেইবনিজ প্রায় একই সময়ে, কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন।
আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২–১৭২৭):
নিউটন ক্যালকুলাসকে “ফ্লাকশন” (fluxion) নামে অভিহিত করেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষত তার বিখ্যাত গতিসূত্র (Laws of Motion) এবং মহাকর্ষ তত্ত্ব (Theory of Gravitation) ব্যাখ্যা করার জন্য এটি ব্যবহার করেন। নিউটনের আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল গতিশীল বস্তুর পরিবর্তনশীল হার (rate of change) এবং বক্ররেখার স্পর্শক (tangent) নির্ণয় করা। তিনি তার কাজগুলি মূলত ব্যক্তিগত নোট এবং পাণ্ডুলিপির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
- ধারণা: ফ্লাক্সিয়নস (পরিবর্তনের হার) ও ফ্লুয়েন্টস (সময় ধরে সঞ্চিত রাশি)।
- ১৬৬০–৭০ দশকে পদ্ধতি গড়ে তোলেন; ১৬৮৭ সালে Principia-য় (জ্যামিতিক ভাষায়) প্রয়োগ করে আকাশযান্ত্রিকতায় বিপ্লব ঘটান। তাঁর বিস্তৃত বই Method of Fluxions মরণোত্তর (১৭৩৬) ছাপা হয়।
গটফ্রিড উইলহেল্ম লেইবনিজ (Gottfried Wilhelm Leibniz ,১৬৪৬–১৭১৬)
লাইবনিৎস ক্যালকুলাসকে আরও পরিকল্পিত এবং সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করেন। তার ব্যবহৃত প্রতীক (যেমন: dx, ∫) এবং নোটেশন (notation) আজও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। লাইবনিৎস তার কাজগুলি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতেন, যার ফলে তার পদ্ধতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং গণিতবিদদের মধ্যে এটি সহজেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তার পদ্ধতি ছিল আরও বিমূর্ত এবং তাত্ত্বিক।
- ১৬৮৪–৮৬ সালে ডেরিভেটিভকে dy/dx\mathrm{d}y/\mathrm{d}xdy/dx, ইন্টেগ্রালকে ∫\int∫ চিহ্নে প্রকাশ করে ছাপান—আধুনিক নোটেশনের জনক।
- সমষ্টিগত যোগফলের ধারাকে প্রতীকীভাবে ধরে ফেলার জোরালো বীজগাণিতিক ব্যাকরণ দেন।
“প্রায়োরিটি” বিতর্ক
১৭শ শতকের শেষভাগে কে আগে আবিষ্কার করেছেন তা নিয়ে তীব্র বিরোধ বাধে। একটি দীর্ঘ ও তিক্ত বিতর্ক শুরু হয়। এটিকে “ক্যালকুলাস বিতর্ক” (The Calculus Controversy) বলা হয়। যদিও এখন এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত যে দুজনেই স্বাধীনভাবে এই তত্ত্বের জন্ম দিয়েছেন। নিউটন আগে ভেবে থাকলেও কম প্রকাশ করেছেন; লেইবনিজ পরে ভেবেও আগে প্রকাশ করেছেন। আধুনিক ইতিহাসবিদদের ঐকমত্য: এটি স্বতন্ত্র, প্রায় সমসাময়িক দ্বৈত আবিষ্কার—আর লেইবনিজের নোটেশন ও পদ্ধতি শিক্ষায় ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। পাঠ্যপুস্তকে তাদেরকে সাধারণত সহ-প্রবর্তক (co-founders) বলা হয়।
ক্যালকুলাসের দ্রুত বিস্তার (১৮শ শতাব্দী)
- বারনুলি ভাইরা (যাকব, জোহান): ভ্যারিয়েশন ক্যালকুলাস, ব্র্যাকিস্টোক্রোন সমস্যা, ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ।
- ল’হোপিতাল (১৬৯৬): প্রথম পাঠ্যপুস্তক—ল’হোপিতালের নিয়ম জনপ্রিয় হয়।
- ইউলার (১৭০৭–১৭৮৩): ফাংশনের ধারণা, ধারার ক্যালকুলাস, বিশেষ ফাংশন, ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ—ক্যালকুলাসকে পদার্থবিদ্যা-প্রকৌশলে কর্মক্ষম “যন্ত্র” বানান।
- ফুরিয়ে (১৮০৭ থেকে): ফুরিয়ে ধারা—ইন্টেগ্রেশন/সমষ্টি/অভিসৃতি প্রশ্নে নতুন পথ; তাপ সমীকরণে ক্যালকুলাসের শক্তি প্রমাণিত।
কঠোর ভিত্তি নির্মাণ (১৯শ শতাব্দী)
- কসি: সীমা ও ধারাবাহিকতা—প্রমাণভিত্তিক ক্যালকুলাসের সূচনা।
- বোলজানো, ভাইয়ারস্ট্রাস: ε\varepsilonε–δ\deltaδ সংজ্ঞা—ডেরিভেটিভ/অভিসৃতি কঠোরভাবে স্থির।
- রিম্যান: রিম্যান ইন্টেগ্রাল—ক্ষুদ্র উপবিভাগের যোগফলে ক্ষেত্রফল/সঞ্চিতি সংজ্ঞায়িত।
- লেবেগ (২০শ শতারম্ভ): লেবেগ ইন্টেগ্রাল—পরিমাপ তত্ত্বের ভিত্তিতে ইন্টেগ্রেশন; বিশ্লেষণকে আধুনিক রূপ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রভাব
- পদার্থবিদ্যা: নিউটনের গতি-তত্ত্ব, লাগরাঞ্জ-হ্যামিল্টনীয় মেকানিক্স, তড়িৎচৌম্বকত্ব, আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম—সবখানেই ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ।
- প্রকৌশল ও কম্পিউটিং: অপ্টিমাইজেশন, নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব, সিগন্যাল প্রসেসিং, সংখ্যাতাত্ত্বিক ক্যালকুলাস। গ্রাফিক্স, অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে ক্যালকুলাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- অর্থনীতি : বাজার বিশ্লেষণ, সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য এবং সর্বোত্তম লাভ-ক্ষতির মডেল তৈরিতে এর ব্যবহার অনস্বীকার্য। ক্যালকুলাস আবিষ্কারের পর থেকে এটি বিজ্ঞান, প্রকৌশল, অর্থনীতি এবং অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
- পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশল: গতি, বল, বিদ্যুৎ, চুম্বকত্ব এবং তাপগতিবিদ্যার মতো ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তনশীল হার এবং জটিল সমীকরণ সমাধানের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
সংক্ষিপ্ত টাইমলাইন
- খ্রি.পূ. ৩য় শতাব্দী: আর্কিমিডিসের এক্সহস্টশন পদ্ধতি
- ১৪–১৬শ শতাব্দী: কেরল স্কুল—ত্রিকোণমিতিক ধারাসমূহ
- ১৬৩০–৬০: ক্যাভালিয়েরি, ফের্মা, ডেকার্ত—অবিভাজ্য, ট্যানজেন্ট, কো-অর্ডিনেট
- ১৬৮৪–৮৭: লেইবনিজের প্রকাশনা; নিউটনের Principia
- ১৭০০–১৭৮০: বারনুলি, ইউলার—ক্যালকুলাসের প্রসার
- ১৮২০–১৮৭০: কসি, ভাইয়ারস্ট্রাস, রিম্যান—কঠোর ভিত্তি
- ১৯০০–১৯১০: লেবেগ—আধুনিক ইন্টেগ্রেশন
সারসংক্ষেপ
ক্যালকুলাসের জন্ম কোনো একক প্রতিভার অনুপ্রেরণায় নয়; বহু সভ্যতার বহু শতকের পরীক্ষানিরীক্ষা, ধারার ধারণা, সীমা, ট্যানজেন্ট, ক্ষেত্রফল—সব মিলিয়ে ১৭শ শতকে নিউটন ও লেইবনিজ তার পূর্ণাঙ্গ ভাষা দেন। এরপর ১৮–১৯শ শতকে এর কঠোর ভিত্তি গড়ে ওঠে, আর ২০শ শতক থেকে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান-প্রকৌশল–অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি শাখার “কার্যকর ভাষা” হয়ে থাকে ক্যালকুলাস। ক্যালকুলাস আবিষ্কার আধুনিক গণিত এবং বিজ্ঞানের ধারণাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এটি শুধু একটি গাণিতিক পদ্ধতি নয়, বরং একটি নতুন চিন্তার মাধ্যম যা আমাদের পরিবর্তনশীল জগতকে বুঝতে সাহায্য করে।